Definition of Soil in Farmers' Language and Types
কৃষকের ভাষায় মাটি কাকে বলে? মাটির প্রকারভেদ ও চেনার সহজ উপায়
- আপডেট সময় : ০৫:০৬:৪৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ৭ বার পড়া হয়েছে
কৃষকের ভাষায় মাটি কাকে বলে—এই প্রশ্নটি আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও এর উত্তরটি বেশ গভীর। ভূ-তত্ত্ববিদ বা বিজ্ঞানীরা মাটির এক ধরনের সংজ্ঞা দেন, কিন্তু যারা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে ফসল ফলান, সেই কৃষকদের কাছে মাটির সংজ্ঞা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের কাছে মাটি শুধু ভূপৃষ্ঠের ওপরের স্তর নয়, মাটি হলো তাদের জীবিকা, তাদের মা এবং ফসলের ভাণ্ডার।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে মাটিকে বলা হয় ‘সোনা’। কারণ এই মাটিই মানুষকে অন্ন, বস্ত্র এবং আশ্রয় দেয়। আজকের আর্টিকেলে আমরা পাঠ্যবইয়ের জটিল সংজ্ঞা এড়িয়ে একদম মাঠ পর্যায়ের কৃষকের দৃষ্টিকোণ থেকে জানব মাটি আসলে কী, তারা মাটিকে কীভাবে চেনেন এবং ভালো মাটি চেনার উপায়গুলো কী কী।
কৃষকের ভাষায় মাটির সংজ্ঞা
কৃষক যখন লাঙ্গল দেন বা কোদাল চালান, তখন তার ফলা যতটুকু গভীরে যায়, সেটুকুই তার কাছে মাটি। সহজ কথায় কৃষকের ভাষায় মাটির সংজ্ঞা হলো:
“ভূপৃষ্ঠের ওপরের যে নরম স্তরে (সাধারণত ৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি) গাছপালার শিকড় চলাচল করতে পারে, সেখান থেকে গাছ তার প্রয়োজনীয় রস (পানি) ও খাবার (পুষ্টি) সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে এবং ফসল ফলায়—তাকেই মাটি বলে।”
কৃষকের কাছে মাটি হলো গাছের ‘খাবার ঘর’। তারা বিশ্বাস করেন, যে মাটি যত বেশি রসালো এবং ঝুরঝুরে, সেই মাটি তত বেশি শক্তিশালী। মাটি যদি গাছের শিকড়কে শক্তভাবে ধরে রাখতে পারে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগাতে পারে, তবেই কৃষক তাকে ‘আসল মাটি’ বলেন।
মাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য: কৃষকের দৃষ্টিতে
কৃষকরা ল্যাবরেটরিতে মাটি পরীক্ষা করেন না, তারা মাটির রঙ, গন্ধ এবং স্পর্শ দিয়ে মাটি চেনেন। তাদের কাছে মাটির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
১. জো (Tilth): এটি কৃষকের কাছে মাটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা। বৃষ্টির পর মাটি যখন খুব শুকনাও থাকে না আবার খুব কাদাও থাকে না—হাতে নিলে ঝুরঝুরে মনে হয়, তাকে ‘জো’ বা ‘বতর’ বলা হয়। এই অবস্থায় লাঙ্গল দিলে মাটি ধুলোর মতো গুঁড়ো হয় এবং ফসল বোনার জন্য উপযুক্ত হয়।
২. রস বা আর্দ্রতা: মাটিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখার ক্ষমতা আছে কি না। যে মাটি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়, কৃষক তাকে ‘তৃষ্ণার্ত মাটি’ বলেন।
৩. প্রাণ: কৃষকের কাছে মাটির প্রাণ হলো কেঁচো এবং জৈব সার। যে মাটিতে কেঁচো বেশি, সেই মাটিকে তারা উর্বর বা জীবন্ত মাটি মনে করেন।
➤ আরও পড়ুন: পুঁজিবাদ কাকে বলে? পুঁজিবাদের সংজ্ঞা, প্রধান ৭টি বৈশিষ্ট্য ও সুবিধা-অসুবিধা
মাটির প্রকারভেদ ও চেনার উপায়
বিজ্ঞানীরা মাটিকে বহু ভাগে ভাগ করলেও, বাংলাদেশের কৃষকরা মাটিকে প্রধানত ৩টি ভাগে ভাগ করে থাকেন। প্রতিটি মাটির চরিত্র এবং ফসলের ধরন আলাদা।
১. বেলে মাটি (Sandy Soil)
কৃষকের ভাষায় একে ‘হালকা মাটি’ বলা হয়।
- চেনার উপায়: এই মাটির দানাগুলো মোটা। হাতে নিয়ে চাপ দিলে দলা পাকায় না, ঝুরঝুর করে পড়ে যায়।
- বৈশিষ্ট্য: এটি পানি ধরে রাখতে পারে না। সেচ দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই শুকিয়ে যায়।
- ফসল: ফুটি, তরমুজ, চীনা বাদাম, মিষ্টি আলু এবং কিছু কিছু শাক-সবজি ভালো জন্মে।
২. এঁটেল মাটি (Clay Soil)
কৃষকরা একে ‘ভারী মাটি’ বা ‘আঠালো মাটি’ বলেন।
- চেনার উপায়: এর দানা খুব মিহি। ভিজলে খুব আঠালো হয় এবং হাতে লাগে। আবার শুকালে ইটের মতো শক্ত হয়ে ফেটে যায়। এই মাটিতে লাঙ্গল চালানো খুব কষ্টের।
- বৈশিষ্ট্য: এটি প্রচুর পানি ধরে রাখতে পারে কিন্তু বাতাস চলাচল করতে পারে না।
- ফসল: ধান, গম এবং কিছু ডাল জাতীয় শস্য এই মাটিতে ভালো হয়।
৩. দোআঁশ মাটি (Loam Soil)
কৃষকের কাছে এটিই ‘সোনার মাটি’ বা আদর্শ মাটি।
- চেনার উপায়: এতে বালি এবং কাদার ভাগ প্রায় সমান থাকে। হাতে নিয়ে চাপ দিলে দলা হয়, আবার সামান্য চাপ দিলে ভেঙে যায়।
- বৈশিষ্ট্য: এই মাটিতে বাতাস এবং পানি—দুটোই সমানভাবে চলাচল করতে পারে। একে ‘জো’ অবস্থায় আনা খুব সহজ।
- ফসল: ধান, পাট, গম, আলু, সরিষা, মরিচসহ বাংলাদেশের প্রায় সব ধরনের ফসল এই মাটিতে বাম্পার ফলন দেয়।
ভালো ফসল পেতে কৃষকের করণীয়
মাটি যেমনই হোক, কৃষক তার যত্ন দিয়ে তাকে উর্বর করতে পারেন। অভিজ্ঞ কৃষকরা মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কিছু নিয়ম মেনে চলেন:
- জৈব সার ব্যবহার: গোবর সার বা কম্পোস্ট সার মাটির প্রাণ। এটি মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়।
- ফসল পর্যায়: প্রতি বছর একই জমিতে একই ফসল না ফলিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষ করা।
- মাটি পরীক্ষা: বর্তমানে কৃষি অফিসের সহায়তায় মাটির অম্লতা বা ক্ষারত্ব পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় চুন বা সার প্রয়োগ করা।
পরিশেষে বলা যায়, কৃষকের ভাষায় মাটি কাকে বলে—এর উত্তর শুধু সংজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি অনুভূতির বিষয়। কৃষকের কাছে মাটি হলো সৃষ্টির আধার। মাটির গুণাগুণ বুঝেই কৃষক তার ফসলের সিদ্ধান্ত নেন। তাই আধুনিক কৃষি বিজ্ঞানের পাশাপাশি কৃষকের এই সনাতন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের কৃষি ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. পলি মাটি কাকে বলে? বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর জমির ওপর যে নরম ও মিহি মাটির স্তর পড়ে, তাকে পলি মাটি বলে। কৃষকের কাছে এটি আল্লাহ্র আশীর্বাদ, কারণ এই মাটি প্রাকৃতিকভাবেই অত্যন্ত উর্বর হয়।
২. কোন মাটি চাষাবাদের জন্য সবচেয়ে ভালো? নিঃসন্দেহে দোআঁশ মাটি। কারণ এই মাটিতে গাছের শিকড় সহজে ছড়াতে পারে এবং পানি ও বাতাসের ভারসাম্য ঠিক থাকে।
৩. এঁটেল মাটিকে কীভাবে চাষযোগ্য করা যায়? এঁটেল মাটিতে প্রচুর পরিমাণে জৈব সার, ছাই বা কিছুটা বালি মিশিয়ে একে ঝুরঝুরে ও চাষযোগ্য করা যায়।
৪. মাটি ‘লবণাক্ত’ হলে কী সমস্যা হয়? উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে লবণ বেশি থাকে। এতে গাছ মাটি থেকে পানি শোষণ করতে পারে না, ফলে গাছ মরে যায় বা ফলন কমে যায়।
৫. মাটির পিএইচ (pH) বলতে কী বোঝায়? এটি দিয়ে মাটির অম্লতা বা ক্ষারত্ব মাপা হয়। মাটির পিএইচ ৬.০ থেকে ৭.০ এর মধ্যে থাকলে তা ফসলের জন্য সবচেয়ে ভালো।















